পারিবারিক অসচেতনতায় বাড়ছে নারী মাদকসেবী

পারিবারিক অসচেতনতায় বাড়ছে নারী মাদকসেবী


রাশিম মোল্লা, শিক্ষানবিশ আইনজীবী

মাদক এখন শহুরে ছেলেমেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে মাদকসেবী গোষ্ঠীরও। আগে অভিজাত পরিবারের লোকজনই মদপানে অভ্যস্ত ছিল। এখন আর সেই দিন নেই। আজ গ্রামগঞ্জের স্কুলপড়–য়া ছেলেমেয়েরাও মাদাকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এখন প্রকাশ্যেই নেশা করে তারা। গত জানুয়ারি মাসে রাজশাহীতে অতিরিক্ত মদপানে রিতু খাতুন নামে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। রিতু স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। মদপানের আসর বসে বান্ধবী সুরমা খাতুনের বাসায়। দুজনেই মদপান করে।

পারিবারিক অসচেতনতায় বাড়ছে নারী মাদকসেবী

রিতু একটু অতিরিক্ত পান করে। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। এ অবস্থায় রিতু চলে আসে নিজ বাড়ি। তখনও তার শরীর থেকে মদের গন্ধ বের হচ্ছিল। ক্রমান্বয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সে মারা যায়। পরে রিতুর বাড়িতেও পাওয়া যায় মদের বোতল। সম্প্রতি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ৯ম শ্রেণির ৩ ছাত্রী বিদ্যালয়ের বাথরুমে গিয়ে সিগারেটের সঙ্গে গাঁজা সেবন করে। তারা কোল্ড ড্রিঙ্কসের সঙ্গেও সিগারেটের তামাক ভিজিয়ে নেশা করত। একদিন ধরা পড়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে। বহিষ্কার করা হয় তাদের। এ ঘটনায় অভিববকরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে দোষারুপ করে। বিভিন্ন সূত্র মতে, খোদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদক বেচাকেনা হয়। কারাগার মাদক ব্যবসার নিরাপদ স্থান হলে এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? অভিভাবকরা এ পরিস্থিতি দেখে চিন্তিত তাদের সন্তানদের নিয়ে। মাদকের হিংস্র ছোবল অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে ১০০ কোটি ধূমপায়ীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ বা ২০ কোটি নারী। বাংলাদেশেও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বাড়ছে। আর দেশের মোট মাদকাসক্তের এক-তৃতীয়াংশ নারী। দিন দিন বাড়ছে সেই সংখ্যা। বাংলাদেশ জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, দেশে মোট নারীর দুই কোটিরও বেশি তামাক সেবন ও ধূমপানে আসক্ত। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) পরিচালিত ২০১২ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে, দেশের ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা চার লাখ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানীতে ডিজে পার্টির নামে বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মাদকের রমরমা আসর বসে। এখানে সাধারণত ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণ-তরুণীদেরই যাওয়া-আসা করে বেশি। প্রথম শ্রেণির একটি দৈনিকের ভয়ংকর তথ্য হলো- ২০২০ সালের মধ্যে দেশে এক কোটি লোক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়বে। এমন আশঙ্কা মাদকাসক্তি নিরাময়ের কর্মকা-ে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, প্রতি বছর শুধু নেশার পেছনেই খরচ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান মেয়েদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে গেছে। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও পাল্লা দিয়ে মাদকের দিকে ঝুঁকছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে তিনটি প্রধান বিষয় কাজ করে। এগুলো হলো- বাবা-মায়ের সন্তনের প্রতি খেয়াল না রাখা, ছেলেমেয়েদের হাতে অতিরিক্ত টাকা দেয়া এবং খারাপ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেশা। সর্বোপরি পারিবারিক অশান্তি ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। ঐশী রহমান তার জ্বলন্ত প্রমাণ। পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান দম্পতির একমাত্র মেয়ে তিনি। ওই মেয়েই নির্মমভাবে হত্যা করে পিতা- মাতাকে। তাদের পরিবারে অভাব ছিল ধর্মীয় অনুশাসন ও বাংলাদেশের কালচারের। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি বাবা-মা দুজনেই ছিল চাকরিজীবী। ছোটবেলা থেকেই সে পিতামাতার আদর-অনুশাসন থেকে বঞ্চিত। এ কারণেই সে ধীরে ধীরে মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং একসময় নেশার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এই নেশার মাধ্যমে সে নতুন একটি সঙ্গ নেশাগ্রস্ত বন্ধু খুঁজে পান। যা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাইকোর্টের এই পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, ঐশী চতুর্থ অথবা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বাবার সংরক্ষিত মদ থেকে মদপান শুরু করে। এরপর ২০১২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মদপানে সে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। এরপর ২০১১ সাল থেকে শিশা এবং ২০১২ সাল থেকে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন শুরু করে। বিপদগামী এসব নেশাগ্রস্ত তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করতে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি এলাকার সচেতন মহলকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসা দরকার। মাদকের এই ছোবল থেকে রক্ষা করতে জনসাধারণকে পারিবারিকভাবে সচেতন হতে হবে। মরণ নেশা বন্ধে সব ধরনের উদ্যোগ না নেয়া হলে ভবিষ্যতে আমাদের যুবসমাজ ধ্বংসের পাশাপাশি সমাজ জীবনও ভেঙে যাবে। এ দেশে জন্ম নেবে হাজারো ঐশী।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment